সুমি আক্তারের বয়স ১২। পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী। পড়াশোনায়ও মোটামুটি ভালো। ৩৫ ছাত্র-ছাত্রীর মধ্যে ক্লাসে রোল ৪। কিন্তু করোনার এই সময়ে বিয়ে হয়ে গেছে তার। এই কিশোরী এখন স্বামীর সংসারের বোঝা টানা শিখছে। করোনায় বাবার সংসারে অভাব আরো তীব্র হওয়ায় পড়াশোনাসহ তার অনেক স্বপ্ন-সাধ চাপা পড়ে গেছে।
সুমি বাগেরহাটের শরণখোলা উপজেলার সাউথখালী ইউনিয়নের প্রত্যন্ত চর এলাকা শরণখোলা গ্রামের নবী হোসেন হাওলাদারের মেয়ে। সুন্দরবনঘেঁষা ১০০ নম্বর দক্ষিণ খুড়িয়াখালী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রী সে।
করোনাকালে শরণখোলায় অপ্রাপ্তবয়স্ক হিসেবে শুধু সুমিরই বিয়ে হয়নি; পঞ্চম থেকে এসএসসি পর্যন্ত ছয় শতাধিক ছাত্রীর বিয়ে হয়ে গেছে এই উপজেলায়। আর গ্রামাঞ্চলের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই যে এমন হয়েছে, তা নয়। উপজেলা সদর ও আশপাশের ঐতিহ্যবাহী স্কুল-মাদরাসার বহু শিক্ষার্থীও অকালে বিয়ে হয়ে গেছে। এর মধ্যে মাদরাসার চেয়ে স্কুলে বিয়ের হার বেশি। সম্প্রতি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার পর ছাত্রীদের ব্যাপক হারে অনুপস্থিতি দেখে শিক্ষকরা খোঁজ নিয়ে জানেন, সে মেয়েগুলো আর আসবে না পড়তে; কারণ তারা এখন অন্য পরিবারের বউ। ক্লাসে যোগ দেওয়া অবশিষ্ট ছাত্র-ছাত্রীরা পাশের শূন্য বেঞ্চে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
সুমির বাবা নবী হোসেন সুন্দরবনে মাছ ধরে সংসার চালান। ভিটেমাটি বলতে আছে এক শতক চরের জমি। ছোট্ট একটি ঘর তুলে তাতেই বসবাস। সংসারে মানুষ ছয়জন। স্বামী, স্ত্রী, তিন মেয়ে আর এক ছেলে। মেয়েদের মধ্যে সুমি সবার বড়। সংসারে অভাব-অনটন লেগেই থাকে। এমন পরিস্থিতিতে যোগ হয় মহামারি করোনা। স্কুল বন্ধ। মা-বাবা পড়ে যান এক ঘোর অনিশ্চয়তায়। তাই অভাবের সংসারে চাপ কমাতে এক মাস আগে বিয়ে দিয়ে দেন বড় মেয়েটিকে।
গত বৃহস্পতিবার সকালে প্রত্যন্ত গ্রামে সুমির স্কুলটিতে গিয়ে জানা যায় সুমির বিয়ের কথা। ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মমতাজ খানম জানান, স্কুল খোলার পর পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী সুমি আর ক্লাসে আসেনি। পরে খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, তার বিয়ে হয়ে গেছে। তিনি আফসোস করে বলেন, ‘মেয়েটি ভালো ছাত্রী ছিল। ওর বাবা খুব গরিব। তাই এত অল্প বয়সে মেয়েটিকে বিয়ে দিয়েছেন। করোনার কারণেই অকালে ঝরে গেল মেয়েটি। স্কুল খোলা থাকলে এমনটি হতো না।’
সহপাঠী রাবেয়া আক্তার, জান্নাতী আক্তার ও সুমন গাজী জানায়, স্কুল খোলার পর সুমিকে না দেখে তারা খোঁজ নিয়ে জানতে পারে, ওর বিয়ে হয়ে গেছে। সুমির বিয়ে হওয়ায় ওদের খুব মন খারাপ। ওরাও বলে, এত অল্প বয়সে বিয়ে দিয়ে সুমির মা-বাবা ঠিক করেননি।
পরদিন শুক্রবার সকাল ১১টার দিকে যাওয়া হয় সুমিদের বাড়িতে। বাবা নবী হোসেনকে বাড়িতে পাওয়া যায়নি। তিনি গেছেন সুন্দরবনে মাছ ধরতে। সুমি শ্বশুরবাড়ি থেকে কয়েক দিন আগে এসেছে বাবার বাড়িতে।
তার সঙ্গে কথা বললে সুমি বলে, ‘বিয়েতে আমার মত ছিল না। ইচ্ছার বিরুদ্ধেই মা-বাবা আমাকে বিয়ে দিয়েছেন।’ বিয়ে হয়ে গেলেও সুমি সমাপনী পরীক্ষা দেওয়ার ইচ্ছার কথা জানায়।
মেয়েকে এত কম বয়সে বিয়ে কেন দিলেন—জানতে চাইলে সুমির মা মুকুল বেগম বলেন, ‘সংসারে খাওয়াইয়া (সদস্য) ছয়জন। ওর বাপে জঙ্গলে মাছ ধইরা কয় টাহা আর পায়? তা দিয়া সংসার চলে না। তার উপর তিনডা মাইয়া বিয়া দিমু ক্যামনে? ইশকুল কবে খোলবে তারও ঠিক নাই। মাইয়াও বড় অইতে আছে। লেহাপড়া বন্ধ। তাই ভালো পোলা (ছেলে) পাইয়া বিয়া দিয়া দিছি। জামাই গারমেন্সে (গার্মেন্ট) চাকরি করে।’
এর পরদিন শনিবার সকালে উপজেলা সদরের ঐতিহ্যবাহী রায়েন্দা সরকারি পাইলট হাই স্কুলে গিয়ে জানা যায়, করোনার বন্ধে নবম, দশম ও এসএসসি পরীক্ষার্থী মিলিয়ে এই প্রতিষ্ঠানের ৫০ জনের মতো বিয়ে হয়ে গেছে। এসএসসিতে ৬৮ জন মেয়ে পরীক্ষার্থী। এর মধ্যে ২০ জনেরই বিয়ে হয়ে গেছে।
সুন্দরবনসংলগ্ন চালিতাবুনিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে জানা যায়, নবম, দশম ও এসএসসি পরীক্ষার্থী মিলিয়ে বিয়ে হয়েছে ২৫ জন ছাত্রীর। এদের মধ্যে কয়েকজন এখনো বিদ্যালয়ে আসছে। বাল্যবিয়ের শিকার নবম শ্রেণির ফাতিমা আক্তার জানায়, স্কুল বন্ধ থাকায় ঢাকায় খালার বাসায় বেড়াতে যায় সে। তখন পরিবারের পছন্দে প্রতিবেশী এক সৌদিপ্রবাসীর সঙ্গে বিয়ে দেয় তাকে। তবে বিয়ে হলেও লেখাপড়া চালিয়ে যেতে চায় সে। এসএসপি পরীক্ষার্থী রিমা আক্তার জানায়, তার ইচ্ছার বিরুদ্ধেই বিয়ে দেওয়া হয়েছে।
জানা গেছে, জনতা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ১৬ জন, খোন্তাকাটা ইউনিয়ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ১৭ জন, খোন্তাকাটা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ১৪ জন, বিকে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ১২ জন, সাউথখালী মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ে ২৩ জন, আমেনা স্মৃতি নিম্ন মাধ্যমিক (ষষ্ঠ থেকে অষ্টম) বিদ্যালয়ের ১৫ জন, তাফালবাড়ী কলেজিয়েট স্কুলে সপ্তম শ্রেণি থেকে এসএসসি পর্যন্ত ১৫ জন, রাজাপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ১৫ জন এবং উপজেলা সদরের আরকেডিএস বালিকা বিদ্যালয়ে ১১ জনের গত কিছুদিনের মধ্যে বিয়ে হয়ে গেছে। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে যে হিসাবটি জানা গেছে, এভাবে উপজেলার ২০টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের গড়ে ২০ জন হিসাবে কমপক্ষে ৪০০ ছাত্রীর বিয়ে হয়েছে বলে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে।
পাশাপাশি মাদরাসার অধ্যক্ষ ও সুপারদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সুন্দরবন দাখিল মাদরাসায় নবম, দশম ও দাখিল পরীক্ষার্থী মিলিয়ে বিয়ে হয়েছে ১৩ জনের। উপজেলা সদরের রায়েন্দা-রাজৈর ফাজিল মাদরাসায় অষ্টম থেকে দাখিল পরীক্ষার্থীদের মধ্যে বিয়ে হয়েছে ১০ জনের, দারুল হেদায়েত নেছারুল উলুম ফাজিল মাদরাসায় ১২ জন, রায়েন্দা মহিলা দাখিল মাদরাসায় নবম, দশম ও দাখিল পরীক্ষার্থীদের মধ্যে ১৮ জন, রায়েন্দা বাজার ইসলামিয়া দাখিল মাদরাসায় ছয়জন এবং সোনাতলা ইসলামিয়া আলিম মাদরাসায় ২০ জনের বিয়ে হয়েছে। এ হিসাবে উপজেলার ১৬টি মাদরাসায় গড়ে ১৫ জন করে প্রায় ২৪০ জন ছাত্রীর বিয়ের খবর জানা যায়।
প্রতিষ্ঠানপ্রধানরা জানান, বাল্যবিয়ের পাশাপাশি ছাত্র-ছাত্রীদের অনুপস্থিতির সংখ্যাও কম নয়। গড় হিসাবে ৪০ শতাংশ আর কোনো দিনই বিদ্যালয়মুখী হবে না বলে তাঁরা হতাশা প্রকাশ করেন।
উপজেলা মাদরাসা শিক্ষক সমিতির সভাপতি মাওলানা আব্দুল জলিল আনোয়ারী বলেন, দীর্ঘদিন প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকা, পারিবারিক অসচ্ছলতা এবং অভিভাবকদের অসচেতনতায় বাল্যবিয়ের সংখ্যা বেড়েছে। স্কুল-মাদরাসা খোলা থাকলে শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের সংস্পর্শে থাকত, খোঁজখবর নেওয়া যেত। তখন আর এই পরিস্থিতি হতো না।
রায়েন্দা সরকারি পাইলট হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক মো. সুলতান আহমেদ গাজী বলেন, ‘স্কুল বন্ধ থাকায় ছেলেমেয়েদের খোঁজ নেওয়া সম্ভব হয়নি। দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ থাকায় অভিভাবকরাও অনিশ্চয়তায় পড়ে যান। এ ছাড়া সুন্দরবনঘেঁষা এই এলাকার বেশির ভাগ পরিবারই নিম্ন আয়ের। তাই অনেকে পরিবারের বোঝা মনে করে মেয়েকে অপ্রাপ্ত বয়সেই বিয়ে দিয়ে দেয়। পরিবার ইচ্ছা করেই মেয়েকে অন্ধকারে ঠেলে দিচ্ছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা থাকলে এত বেশি বিয়ে হতো না।’
উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. নূরুজ্জামান খান বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার পর প্রাথমিকভাবে খোঁজ নিয়ে অসংখ্য বাল্যবিয়ের খবর জানতে পেরেছি। বাল্যবিয়ের সঠিক তথ্য দেওয়ার জন্য প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে চিঠি দেওয়া হয়েছে। পরবর্তী সময়ে যাতে আর এমন অপ্রাপ্তবয়স্ক বিয়ের ঘটনা না ঘটে, সে ব্যাপারে শিক্ষক, ছাত্র-ছাত্রী ও অভিভাবকদের নিয়ে সচেতনতামূলক সভা করা হবে।
এ ব্যাপারে শরণখোলা সরকারি কলেজের সহকারী অধ্যাপক ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান এইচ এম আব্দুল হালিম বলেন, করোনার দুর্যোগে শিক্ষাব্যবস্থার চরম ক্ষতি হয়ে গেছে। বাল্যবিয়ের প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে আশঙ্কাজনক হাবে। এটি একটি সামাজিক অবক্ষয়। অল্প বয়সে বিয়ে হওয়ার ফলে মেয়েরা শারীরিক ও মানসিকভাবে স্থায়ী ক্ষতির মুখে পড়বে। পারিবারিক কলহ বৃদ্ধি পাবে। সমাজে এর ক্ষতিকর প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী। এ ব্যাপারে অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে।
শরণখোলা উপজেলায় গত চার মাসে প্রশাসন জানার পর পাঁচ-ছয়টি বাল্যবিয়ে বন্ধ করতে পেরেছে। কিন্তু এতে বিপুলসংখ্যক অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়ের বিয়ে হওয়া যাওয়ার বিষয়টি তারা টেরই পায়নি বলে জানা গেছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) খাতুনে জান্নাত এ প্রসঙ্গে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘অনুষ্ঠান করে বিয়ে হলে জানাজানি হয়। আমরা তা বন্ধ করতে উদ্যোগী হই। কিন্তু করোনার এই সময়ে গোপনেই বেশির ভাগ বিয়ে সারা হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘বাল্যবিয়ে সমাজের জন্য একটি অশনিসংকেত। এটি আমাদের সম্মিলিতভাবে প্রতিরোধ করতে হবে। ক্ষতি যা হওয়ার হয়ে গেছে। সামনে যাতে আর এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত বিয়ে না হয়, সে ব্যাপারে শিগগিরই জনপ্রতিনিধি, শিক্ষক, অভিভাবক, ইমাম, পুরোহিত, কাজি ও গ্রাম পুলিশের সমন্বয়ে এলাকাভিত্তিক সভা করা হবে।’
ব্র্যাকের এক গবেষণায় উঠে এসেছে, করোনাকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় অন্যান্য সময়ের তুলনায় দেশে বাল্যবিবাহ ১৩ শতাংশ বেড়েছে, যা ২৫ বছরে সর্বোচ্চ। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের এক জরিপ বলছে, গত বছরের এপ্রিল থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত দেশের ২১ জেলার ৮৪টি উপজেলায় ১৩ হাজার
৮৮৬টি বাল্যবিবাহ হয়েছে। সবচেয়ে বেশি বাল্যবিবাহ হয়েছে বরগুনায়, এক হাজার ৫১২টি।
kalerkantho